অতিরিক্ত ঘাম কোন রোগের লক্ষণ: জানুন কারণ ও প্রতিকার
আপনি কি জানেন, আপনার শরীর থেকে অতিরিক্ত ঘাম হওয়া শুধু গরমে বা শারীরিক পরিশ্রমের কারণ নয়? অনেক সময় এটি আপনার শরীরের গভীরে লুকিয়ে থাকা কোনো রোগের সংকেতও হতে পারে।
আপনি যদি হঠাৎ করেই বেশি ঘামে ভুগতে শুরু করেন, বিশেষ করে যখন কোন স্পষ্ট কারণ নেই, তাহলে আপনার অবশ্যই সতর্ক হওয়া উচিত। এই অতিরিক্ত ঘাম হতে পারে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, ভিটামিনের অভাব কিংবা হাইপারহাইড্রোসিসের মতো বিভিন্ন রোগের লক্ষণ। আপনার শরীরের এই সংকেতগুলোকে উপেক্ষা না করে সঠিক সময়ে বুঝে নেওয়া খুবই জরুরি।
এই নিবন্ধে আমরা বিস্তারিত জানাবো, অতিরিক্ত ঘাম কোন কোন রোগের লক্ষণ হতে পারে, কীভাবে আপনি এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারেন, এবং কখন ডাক্তারের সাহায্য নেওয়া উচিত। তাই পড়া চালিয়ে যান, আপনার স্বাস্থ্যের জন্য এটি হতে পারে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা।
অতিরিক্ত ঘামের কারণ
অতিরিক্ত ঘামের কারণ অনেক ধরনের হতে পারে। ঘাম শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণের একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। কিন্তু কখনো কখনো ঘাম স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়। এটি বিভিন্ন শারীরিক বা মানসিক সমস্যার ইঙ্গিত হতে পারে। নিচে অতিরিক্ত ঘামের কয়েকটি প্রধান কারণ আলোচনা করা হলো।
হাইপারহাইড্রোসিস কী
হাইপারহাইড্রোসিস হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে শরীর অতিরিক্ত ঘাম উৎপাদন করে।
এটি সাধারণত হাত, পা, কপাল ও বগলে বেশি দেখা যায়।
এই রোগের কারণে ঘাম নিয়ন্ত্রণের নিউরোলজিক্যাল সিগন্যালগুলি ত্রুটিপূর্ণ হয়।
হাইপারহাইড্রোসিসে ঘাম খুব বেশি হওয়ায় জীবনযাত্রায় অসুবিধা হয়।
ভিটামিনের ঘাটতি ও ঘাম
ভিটামিন ডি বা ভিটামিন বি কম হলে শরীরের বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে।
বিশেষ করে ভিটামিন ডি-এর অভাবে রাতে ঘামের সমস্যা হতে পারে।
মানসিক চাপ এবং ঘাম
মানসিক চাপ বাড়লে শরীরের অ্যাড্রেনালিন হরমোন বেশি উৎপাদিত হয়।
চিন্তা, উদ্বেগ ও হতাশায় ঘাম বেশী হওয়া স্বাভাবিক।
দীর্ঘ সময় মানসিক চাপ থাকলে ঘাম নিয়ন্ত্রণ হারায়।
অন্যান্য শারীরিক সমস্যা
ডায়াবেটিস, থাইরয়েড সমস্যা, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা ঘামের কারণ হতে পারে।
হৃদরোগ বা সংক্রামক রোগেও অতিরিক্ত ঘাম হতে পারে।
শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বিভিন্ন অসুখে ঘামের মাত্রা বেড়ে যায়।

Credit: takhfeehealthcare.com
অতিরিক্ত ঘামের লক্ষণ
অতিরিক্ত ঘাম হওয়া শরীরে কোনো সমস্যার সংকেত হতে পারে। শরীরের স্বাভাবিক ঘামের চেয়ে বেশি ঘাম হলে তা লক্ষণ হিসেবে বিবেচিত হয়। এই অতিরিক্ত ঘামের লক্ষণগুলো শনাক্ত করা জরুরি। কারণ এগুলো শরীরের গোপন রোগ বা অন্য কোনো অসুবিধার ইঙ্গিত দিতে পারে। নিচে অতিরিক্ত ঘামের প্রধান কিছু লক্ষণ আলোচনা করা হলো।
চামড়ার বারবার আর্দ্রতা
অতিরিক্ত ঘামের একটি প্রধান লক্ষণ হলো চামড়ার অবিরাম আর্দ্রতা।
আপনার ত্বক অনেক সময় ভিজে ভিজে থাকবে। এমনকি ঠান্ডা বা শীতল আবহাওয়ায়ও ত্বক আর্দ্র থাকবে।
এটি স্বাভাবিক নয় এবং ত্বকের স্বাস্থ্যের জন্য সমস্যার কারণ হতে পারে।
ত্বকের জ্বালা ও ফুসকুড়ি
অতিরিক্ত ঘাম হলে ত্বকে জ্বালা অনুভব হতে পারে।
ঘামের কারণে ত্বকে ফুসকুড়ি বা র্যাশও দেখা দিতে পারে।
এই ফুসকুড়ি সাধারণত ঘামের জমে থাকা আর্দ্রতার কারণে হয়।
ছত্রাক সংক্রমণের কারণে ত্বকে লালচে দাগ পড়তে পারে।
রাত্রিকালীন ঘাম
রাতে ঘুমানোর সময় যদি অতিরিক্ত ঘাম হয়, তা উদ্বেগের লক্ষণ হতে পারে।
ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে পারে এবং শরীর দুর্বল বোধ করতে পারে।
রাত্রিকালীন ঘাম ইনফেকশন বা হরমোনের সমস্যার ইঙ্গিত দিতে পারে।
হঠাৎ ঘামের ঝরনা
হঠাৎ এবং অপ্রত্যাশিত ঘামের ঝরনা হওয়া গুরুতর লক্ষণ হতে পারে।
এটি হৃদরোগ, ডায়াবেটিস বা থাইরয়েড সমস্যার সংকেত হতে পারে।
এ ধরনের ঘাম আসলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
ঘাম হওয়া রোগের প্রকারভেদ
অতিরিক্ত ঘাম হওয়া বিভিন্ন রোগের অন্যতম লক্ষণ। শরীরের অভ্যন্তরীণ সমস্যা কিংবা বাহ্যিক কারণের প্রভাবে ঘাম বেশি হতে পারে। সচেতন থাকা জরুরি কারণ অনেক সময় ঘামের পেছনে গুরুতর রোগ লুকিয়ে থাকতে পারে। নিচে কিছু প্রধান রোগের প্রকারভেদ তুলে ধরা হলো যা অতিরিক্ত ঘামের সঙ্গে জড়িত।
হৃদরোগের সঙ্গে ঘাম
হৃদরোগের সময় শরীর অতিরিক্ত ঘাম উৎপাদন করে। বিশেষ করে হার্ট অ্যাটাকের সময় প্রচণ্ড ঘাম হয়। বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্টের সঙ্গে ঘামের বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায়। এটি শরীরের জরুরি সংকেত। দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া প্রয়োজন।
ডায়াবেটিস ও অতিরিক্ত ঘাম
ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে ঘাম হওয়া খুব সাধারণ। রক্তে শর্করার মাত্রা কমে গেলে ঘাম বেশি হয়। বিশেষ করে রাতে ঘাম হওয়া বা হাইপোগ্লাইসেমিয়ার লক্ষণ হতে পারে। নিয়মিত রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে মনিটরিং দরকার।
হরমোনের পরিবর্তন
হরমোনের ভারসাম্যহীনতাও অতিরিক্ত ঘামের কারণ হতে পারে। থাইরয়েড সমস্যা, মেনোপজ বা পিএমএস-এর সময় ঘাম বেশি হয়। শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সমস্যা দেখা দেয়। হরমোন টেস্ট করানো জরুরি।
সংক্রামক রোগের প্রভাব
জ্বর, টিবি, ম্যালেরিয়া বা অন্যান্য সংক্রমণেও ঘাম বাড়তে পারে। শরীর রোগ প্রতিরোধের জন্য ঘাম বাড়ায়। দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণে রাতে ঘাম হওয়া সাধারণ। চিকিৎসা শুরু না করলে সমস্যা বাড়তে পারে।

Credit: www.youtube.com
অতিরিক্ত ঘাম কমানোর পদ্ধতি
অতিরিক্ত ঘাম সমস্যার প্রভাব কমাতে কিছু কার্যকর পদ্ধতি অবলম্বন করা জরুরি। ঘামের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখলে জীবনমান উন্নত হয়। ঘরোয়া পদ্ধতি থেকে শুরু করে জীবনের অভ্যাস পরিবর্তন পর্যন্ত নানা উপায় আছে।
ঘরোয়া প্রতিকার
প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে ঘাম কমানো যায়। এলোভেরা জেল ত্বকে লাগালে স্বস্তি মেলে। লেবুর রস মিশিয়ে ব্যবহার করলে ঘামের দুর্গন্ধ কমে। নিয়মিত স্নান করলে ত্বক পরিষ্কার থাকে এবং অতিরিক্ত ঘাম কমে।
স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণ
মানসিক চাপ বেশি থাকলে ঘাম বাড়ে। ধ্যান ও শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম স্ট্রেস কমায়। নিয়মিত যোগব্যায়াম মানসিক শান্তি দেয়। নিয়ন্ত্রণে থাকলে শরীরেও প্রভাব পড়ে এবং ঘাম কম হয়।
পর্যাপ্ত পানি পান
শরীর ঠাণ্ডা রাখতে পর্যাপ্ত পানি পান জরুরি। পানি শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ বের করে। ডিহাইড্রেশন হলে ঘাম বেশি হতে পারে। দিনে অন্তত আট গ্লাস পানি পান করা উচিত।
সঠিক পোশাক নির্বাচন
প্রাকৃতিক সুতির কাপড় শরীর শ্বাস নিতে সাহায্য করে। আঁটসাঁট বা সিন্থেটিক কাপড় পরিধান এড়ানো ভালো। হালকা রঙের পোশাক গরম কম অনুভব করায়। সঠিক পোশাক ঘামের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে।
কখন ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন
অতিরিক্ত ঘাম অনেক সময় শরীরের একটি সংকেত হতে পারে। যখন ঘাম স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয় এবং দৈনন্দিন জীবনে সমস্যা তৈরি করে, তখন ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। বিশেষ করে যদি ঘামের সঙ্গে অন্য কোনো অস্বাভাবিক লক্ষণ যেমন ত্বকের জ্বালা, ফুসকুড়ি বা রাতের সময় ঘাম বেশি হয়, তখন চিকিৎসকের সাহায্য নিতে হবে।
কোন ডাক্তারের কাছে যাবেন
প্রাথমিকভাবে একজন সাধারণ রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়া ভালো। তারা সমস্যা বুঝে উপযুক্ত চিকিৎসকের কাছে রেফার করতে পারবেন। ঘাম বেশি হলে চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ বা ডার্মাটোলজিস্টের পরামর্শ নিতে পারেন। কখনো কখনো এন্ডোক্রিনোলজিস্ট বা অভ্যন্তরীণ রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ দরকার হতে পারে। কারণ অতিরিক্ত ঘাম হরমোন বা অন্য শারীরিক সমস্যার কারণে হতে পারে।
চিকিৎসার বিভিন্ন বিকল্প
চিকিৎসার জন্য অনেক বিকল্প আছে। সাধারণত অ্যান্টিপারস্পিরেন্ট ব্যবহার শুরু হয়। যদি তা কাজ না করে, তবেই ওষুধ বা থেরাপি প্রয়োগ করা হয়। বোটক্স ইনজেকশন অতিরিক্ত ঘাম কমাতে সাহায্য করে। কিছু ক্ষেত্রে সার্জারি বা লেজার থেরাপিও প্রয়োজন হতে পারে। চিকিৎসক আপনার অবস্থা দেখে সঠিক পদ্ধতি নির্ধারণ করবেন।
চিকিৎসার সময়সূচি
চিকিৎসা শুরু করার আগে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে সময়সূচি ঠিক করতে হবে। সাধারণত প্রথম কয়েক সপ্তাহে নিয়মিত চেকআপ দরকার হয়। ওষুধ বা থেরাপির প্রভাব বুঝতে মাঝে মাঝে ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। যদি কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, তাৎক্ষণিক যোগাযোগ জরুরি। সময়মতো চিকিৎসা করলে ঘামের সমস্যা নিয়ন্ত্রণে আসে।

Credit: mzamin.com
Frequently Asked Questions
কোন রোগের কারণে অতিরিক্ত ঘাম হতে পারে?
অতিরিক্ত ঘাম হাইপারহাইড্রোসিস, ডায়াবেটিস, থাইরয়েড সমস্যা, হার্ট রোগ, সংক্রমণ অথবা স্ট্রেসের কারণে হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে ভিটামিন ডি-এর অভাবও ঘাম বাড়ায়। রোগ নির্ণয়ের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া জরুরি।
কোন ভিটামিনের অভাবে গা ঘামে?
ভিটামিন ডি-এর অভাবে গা অতিরিক্ত ঘামে। এই ঘাম সাধারণ পরিশ্রম ছাড়াও কপালে বিন্দুবিন্দু ঘাম হওয়ার মাধ্যমে প্রকাশ পায়। ভিটামিন ডি কম থাকলে শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণে সমস্যা হয়, ফলে ঘাম বেশি হয়।
অতিরিক্ত ঘাম থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় কী?
অতিরিক্ত ঘাম কমাতে নিয়মিত গোসল করুন, হালকা সুতির পোশাক পরুন, বেশি জল পান করুন এবং স্ট্রেস কমান। ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
অতিরিক্ত ঘামের জন্য কোন ডাক্তার দেখাতে হবে?
অতিরিক্ত ঘামের জন্য সাধারণত ত্বক বিশেষজ্ঞ (ডার্মাটোলজিস্ট) বা নিউরোলজিস্টের কাছে যেতে হয়। তারা ঘামের কারণ নির্ণয় ও চিকিৎসা দেন। হাইপারহাইড্রোসিস বা অন্য কোনও গুরুতর সমস্যা থাকলে তারা উপযুক্ত পরামর্শ দেবেন।
উপসংহার
অতিরিক্ত ঘাম অনেক সময় শরীরের গোপন সমস্যার ইঙ্গিত দেয়। এটি শুধু শারীরিক অস্বস্তি নয়, কিছু রোগের লক্ষণও হতে পারে। হৃদরোগ, ডায়াবেটিস বা হাইপারহাইড্রোসিসের মতো সমস্যা ঘামের মাধ্যমে প্রকাশ পেতে পারে। তাই নিয়মিত ঘামের পরিবর্তন লক্ষ্য করা জরুরি। প্রয়োজন হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। ঘাম নিয়ন্ত্রণে সহজ কিছু উপায় অনুসরণ করা যায়। শরীরের সতর্ক সংকেত এড়িয়ে চলা উচিত নয়। সুস্থ থাকুন, সচেতন থাকুন।
